শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড এ চরম সত্য প্রবাদটি আমাদের কারোরই অজানা নয়। শিক্ষা থেকেই জ্ঞানের প্রাপ্তি। আর জ্ঞানের কদর সর্বসস্তরে। এবং এই জ্ঞানই মানুষকে সাফল্যের স্বর্ণচূড়ায় পৌঁছাত সহায়তা করে।
তাই নিজের এবং সমাজের উন্নতি সাধনে পড়াশোনার বিকল্প আর কিছুই নেই। কিন্তু পড়াশোনা করাটা প্রায় সবারই অপছন্দের জিনিশ। তবুও অপছন্দ হলেও নিজের এবং সসমাজের উন্নয়নের লক্ষ্যে পড়াশোনা আমাদের করতেই হয়। কিন্তু পড়াশোনার ক্ষেত্রে অনেকেই একটা চরম সমস্যার সম্মুখীন হয়। আর সেটা হলো পড়া ভুলে যাওয়া। পড়া ভুলে যাওয়া রোগটি প্রায় সব স্টুডেন্টেরই আছে। কিন্তু কেউ কেউ অনেক পড়েও সেটা কয়েকদিন পর ভুলে যায় কেউ কেউ পড়া মনে রাখার জন্য কিছু ট্রিক (নিয়ম/কৌশল) ব্যবহার করে পড়াশুনা করে এবং দীর্ঘ সময় পর্যন্ত মনে রাখতে সক্ষমতা লাভ করে। সঠিক কোশল অবলম্বন করে না পড়লে পড়া ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে অপর দিকে সঠিক কৌশলে পড়াশোনা করলে দীর্ঘকাল পড়া মনে রাখা যায়।
নিচের ১০ টি কৌশল সঠিক ভাবে অবলম্বন করলে পড়া ভুলে যাওয়া রোগ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
১। আগ্রহ নিয়ে খালি মাথায় পড়তে বসো
খেলা, মুভি দেখার জন্য আপনি যেমন আগ্রহ নিয়ে, জিতার আশা নিয়ে বসো। পড়ার সময়ও একইভাবে, নিজের ভিতর থেকে আগ্রহ নিয়ে, পড়া কঠিন, মনে থাকে না, বুঝি না- এইসব ভুলে, খালি মাথা নিয়ে বসতে হবে। কেননা পড়াশোনা আমাদের সবার কাছেই কম বেশি কঠিন বিষয় অথবা অপছন্দের বিষয়। আর এই কঠিনত্বকে যদি সহজ এবং মনে রাখার উপযোগী করতে হয় তাহলে আগ্রহ থাকাটা অবশ্যক। কেননা যে কাজে আগ্রহ থাকবে না সেই কাজ সঠিক ভাবে সম্পাদন হয় না। ঠিক তেমনি পড়াশোনাতেও আগ্রহ না এবং মাথায় রাজ্যের চিন্তা নিয়ে বসলে পড়া মুখস্ত হয় না। সেই জন্য ভোরে উঠে পড়তে বসলে মাথা ক্লিন থাকে এবং পড়া দ্রুত মাথায় ঢুকে।
৩। কনসেপ্ট ট্রি ব্যবহার করে পড়া
কোন বিষয় পড়ার আগে অধ্যায়গুলোকে কয়েকটি অংশে ভাগ করে নিলে পড়তে সুবিধা হয়। একে একটি গাছের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। গাছটিকে একটি অধ্যায় বিবেচনা করে প্রতিটি পাতায় অংশ গুলোর একটি করে সারমর্ম লিখে পড়লে পড়া মনে রাখতে সহজ হয়। এ পদ্ধতিকে কনসেপ্ট ট্রি বলা হয়। পড়া মনে রাখতে এটি বেশ কার্যকর
৩। ছোট ছোট অংশে ভাগ করে পড়ো
বড় কোন পড়া একত্রে পড়লে আমাদের মেমোরি সেটাকে ধরে রাখতে পারে না ফলশ্রুতি আমরা ভুলে যাই। এই বড় করে পড়ার ভুলটা অনেকেই করে থাকে যার ফলে এই সমস্যাটা সৃষ্টি হয়। কিন্তু ভেবে দেখ পড়াগুলোকে যদি ছোট ছোট অংশে ভাগ করে সেই অংশগুলোকে আগে মুখস্থ করে পরে সবটুকু জোড়া লাগানো হয় তাহলে দেখবে সেই পড়াটা বা সেই কলামটা তুমি সহজেই মুখস্থ করতে পারছো এবং স্থায়িত্ব বহুদিন। তাই সবটুকু একেবারে না পড়ে মুখস্থ করার চেয়ে ছোট ছোট অংশে ভাগ করে মুখস্থ করার প্রক্রিয়াটাই বেশি শ্রেয়।
৪। লিখে লিখে বা ছবি এঁকে পড়ার অভ্যাস করা
কোন জিনিস পড়ার সাথে সাথে লিখলে বা ছবি আঁকলে পড়ার প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়। কারন নিউরো সায়েন্সের মতে, কিছু লিখলে বা ছবি আঁকলে ব্রেইনের অধিকাংশ জায়গা উদ্দীপিত হয় এবং ছবি বা লেখাটিকে স্থায়ী মেমরিতে রূপান্তরিত করে ফেলে। ফলে পড়াটি মস্তিষ্কতে দীর্ঘস্থায়ী হয়। সাধারণভাবেও বুঝা যায়, বইতে যেসব বিষয় ছবি দিয়ে ব্যাখ্যা করা হয় তা-ই আমাদের বেশি মনে থাকে। পরীক্ষার সময়ও চোখের সামনে বইয়ের ছবিটিই ভেসে উঠে। তাই লিখে বা ছবি এঁকে পড়া অনেক কার্যকরী
৫। কালারিং বা মার্কার পেন ব্যবহার করে দাগিয়ে পড়া
অনেকগুলা বৈশিষ্ট্য, পার্থক্য, প্রকারভেদ মনে না থাকলে। সেগুলার প্রথম বর্ণ দিয়ে একটা শব্দ বা ছন্দ তৈরি করুন ফেলো। ভূগোল বা বিজ্ঞানের কঠিন কোন চিত্র বা গ্রাফ থাকলে, গ্রাফের কিছু অংশ কালো, কিছু অংশ নীল, কিছু অংশ লাল রঙের কলম/পেন্সিল দিয়ে আঁকলে, গ্রাফ মনে রাখা সহজ হবে। কোন চ্যাপ্টারের গুরুত্বপূর্ণ গ্রাফ, বিদঘুটে পয়েন্টগুলো কয়েকটা গ্রুপে ভাগ করে আলাদা কালারের কলম দিয়ে খাতায় লিখো। তারপর রিকশায়, বাসে বা সেলুনে চুল কাটার সময় সেই খাতা খুলে সামনে রেখে দিবে। ব্যস, ফ্রি ফ্রি রিভাইজ দেয়া হয়ে যাবে। ইম্পরট্যান্ট চার্ট, পয়েন্টগুলা কাগজে লিখে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখো। কয়েকটা গ্রাফ সিলিং এ লাগিয়ে দাও। যাতে দিনের বেলায় বিছানায় শুলে সেগুলা দেখে দেখে রিভাইজ দেয়া যায়। এই উপায়টি বেশ কার্যকারী পড়া মুখস্থ করার জন্য।
৬। নিমনিক তৈরী করা
আমাদের ব্রেইন অগোছালো জিনিস মনে রাখতে পারে না। দীর্ঘ সময় মনে রাখার জন্য সারিবদ্ধভাবে মেমোরিতে স্টোরেজ করতে হয়। তা না হলে ভূলে যাওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে। তাই পড়াশোনার ক্ষেত্রেও এই ব্যপরটা মাথায় রাখতে হবে। অগোছালো ভাবে কিছু পরলে সেটা মস্তিষ্ক থেকে রিমুভ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই পড়ার সময় কোন কিছু ছক বা টেবিল আকারে সাজিয়ে নিলে কিংবা কবিতার ছন্দ বানিয়ে পড়লে তা সহজেই মনে রাখা যায়। পড়া মনে রাখার এই কৌশল কে নিমনিক (mnemonic) বলা হয়।
৭। বইয়ের পিছনে সামারি লিস্ট
প্রায় সব বইয়ের পিছনেই দুই-এক পাতা সাদা পৃষ্ঠা থাকে। আর না থাকলে স্কচ-টেপ বা পিন দিয়ে লাগিয়ে নিবে। তারপর যে জিনিসগুলা ভুলে যাওয়ার চান্স বেশি বা পরে ভালো করে রিভিশন না দিলে পরীক্ষার হলে লিখতে পারবেন না- সেগুলা পেইজ নাম্বার সহ বইয়ের পিছনের সাদা কাগজে লিখে রাখবে। যাতে ৩-৪ ঘন্টা রিভিশন দেয়ার সুযোগ পাইলে, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিসগুলা পৃষ্ঠা নম্বর দিয়ে খুব সহজেই খুঁজে বের করে রিভিশন দিতে পারো।
৮। রিভাইজ
গবেষণায় দেখা গেছে- আমরা আজকে সারাদিনে যত কিছু, দেখি, শুনি, জানি বা পড়ি তার ৫দিন পরে চারভাগের তিনভাগই ভুলে যাই। তবে এই ভুলে যাওয়া ঠেকানোর জন্য অনেকগুলা ট্রিকস আছে। যেমন- ৪৫ মিনিট পড়ে ১৫ মিনিটের নিবা এবং সেই ব্রেকে পড়াটা মনে মনে রিভাইজ দাও এবং কোথাও আটকে গেলে আরেকবার দেখে নাও। এবং আজকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু পড়লে আগামীকাল ঘুমানোর আগে এই জিনিস ২০মিনিটে রিভাইজ দিয়ে দিবা। তারপর এক সপ্তাহ পরে আরেকবার রিভাইজ দিলে এই পড়ার ৯০% জিনিস এক মাস পর্যন্ত আপনার মনে থাকবে।
প্রত্যেকটা সাবজেক্টের গুরুত্বপূর্ণ জিনিস, ক্লু, সামারি পয়েন্টগুলা আলাদা আলাদা খাতায় লিখে রাখবা। চ্যাপ্টার ওয়াইজ। তারপর টিউশনি যাওয়ার পথে- রিক্সায়, বাসে, এমনকি স্টুডেন্টকে অংক করতে দিয়ে সেই খাতা দেখতে থাকবে। যে জিনিসটা আজকে পড়ছো সেটা- গোসল, ভাত খাওয়া, সিঁড়ি দিয়েই নামা, বাসের জন্য অপেক্ষা, এমনকি বাথরুম করার সময় চিন্তা করবে। যতবেশি চিন্তা করবে, যতবেশি মনে মনে রিভাইজ দিবে তত বেশি মনে থাকবে।
৯। যা পড়েছি তা অন্যকে শেখানো
নিজের জ্ঞান অন্যকে বিলিয়ে দেয়ার মধ্যে মহত্ব লুকিয়ে থাকে। এবং এটি চারিত্রিক ভালো গুন বহন করে। পড়া মনে রাখার জন্য প্রাচীনকাল থেকেই এ পদ্ধতিটি বেশ জনপ্রিয়। নিজে যা পড়েছি বা জেনেছি তা অন্যকে শেখানোর মাধ্যমে মস্তিষ্কে আরো ভালোভাবে গেঁথে যায়। তাছাড়া অন্যকে শেখানোর ফলে নিজের দক্ষতা প্রকাশ পায় এবং পড়াটি ভালভাবে আয়ত্ত হয়েছে কিনা তাও বুঝা যায়। কিন্তু অনেকেই এই কাজটি করে না। নিজেকে গুটিয়ে রাখে, যেটা মোটেও কাম্য নয়।
১০। পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমানো
ঘুমকে বলা হয় সবকিছুর মহা ঔষধ। বেশ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, ব্রেইন যেকোন ইনফরমেশন বা তথ্যকে মেমরি বা স্মৃতিতে পরিণত করে ঘুমানোর সময়। আর ক্ষমতাকেই কাজে লাগাতে হবে। তাই পড়া মনে রাখার জন্য পড়ালেখার পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমানোও জরুরি। সাধারণত একজন সুস্থ ব্যক্তির দিনে ৮ ঘন্টার মত ঘুমানো উচিত। এর থেকে কম ঘুমালে পড়া মনে রাখার ক্ষমতা কমে যায়। তাই কমপক্ষে ৮ ঘন্টা ঘুমানো অত্যন্ত জরুরী।

0 Comments