ধোপার বাড়িতে শাড়ী গেছে আর ধোপার বউ সেই শাড়ীটি পড়ে দেখেনি এমনটা কখনোই হয় না। ঠিক তেমনি শীত এসেছে অথচ আমি কালো শাল পাঁজরে পেঁচিয়ে খালি পায়ে ভোরের কুয়াশা ভেদ করনি এই দৃশ্যটাও বিরল।
কুয়াশা আমার বড্ড প্রিয়, কেননা কুয়াশার একটি পজিটিভ দিক আছে বলে আমি মনে করি। কুয়াশায় সামনে অথবা পিছনের দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়না, এটি ঠিক যেন বর্তমান, এখানে অতিত অথবা ভবিষ্যৎ এর কোন ঠাই নেই। মানুষের জীবনটাও বর্তমানকে ঘিরেই হওয়া উচিৎ ছিল।
কারন মোষ্ট অফ দ্যা পিপল ভবিষ্যৎ এবং অতিত ঘাঁটিয়েই ডিপ্রেশন নামক উগ্র বিষয়ের কাছে ধরা দেয়। ডিপ্রেশনের প্রাথমিক পর্যায়ে দেহের ছোট্ট একটি জায়গা দখল করলেও পরে এটি পুরো শরীর গ্রাস করে ফেলে। এই হাইপোসিসের কল্যানেই হয়ত কুয়াশা আমার বেশ পছন্দ কারন আমি বর্তমান বিশ্বাসী, অতীত বা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবার মত অবসর কই আমার? এখন আবার মজনুর টঙে গিয়ে বসতে হবে।
চায়ের দোকানগুলোতে সচারচার নাম থাকে না তবে এইটায় আছে বিরাট করে কাচা হাতে লেখা "মজনু মিয়া টি স্টোল। যে লিখেছে সে হয়ত ছোট বেলায় কে.জি স্কুলে পড়েনি একেবারে প্রাইমারী লেভেলে ভর্তি হয়েছিল। কেননা কিন্ডারগার্টেনে পড়লে হাতের লেখার শেপ এরকম হওয়ার কথা না। লেখায় আনাড়ি আনাড়ি ভাব আছে।
মজনু দুই পা আসুম গেড়ে বসে দুই হাতের তালু অনবরত ঘোষে যাচ্ছে। এইটা শরীর গরম করার ভালো প্রসেস। এক হাতের তালুর সাথে আরেক হাতের তালু সজোরে ৫ মিনিট যাবত ঘষলেই শরীর পুরোপুরি চাঙ্গা, শীত দৌড়ে পালাবে। মজনুকে আজকে বেশ কম বয়স্কা লাগছে।
পড়নে মেরুন কালারের সুইটার আর মাথায় কালো একটা আমব্রেলা টাইপ টুপি পরেছে। ভালো কালার কম্বিনেশন সাথে টুপিটা তার কাচাপাকা চুলগুলো ঢেকে দিয়েছে, এইজন্যেই বয়সের কোঠা থেকে কিছু সংখ্যা বিয়োগ হয়েছে। বেশ লাগছে ব্যাটাকে। তবে একজন চা বিক্রেতাকে সুন্দর লাগলে হবে না, এদের চোয়ালটা হতে হবে ভাঙ্গা, চোখ গাঢ় লাল। দেখে মনে হবে যেন সদ্য গাজা টেনে এসে বসেছে দোকানে।
বসতে না বসতেই চা চলে এল। পরিচিত টঙের এই হল এক সুবিধা, আপনাকে মুখফুটে কিছু বলতে হবে না চোখের ইশারাতেই দোকানি বুঝে ফেলে। আই কন্ট্রাক্টে পটু হয় একেকটা। এই কনকনে ঠান্ডায় এক কাপ গরম চা আর সাথে চুলো থেকে সদ্য বানানো ধোয়া ওঠা ভাপা পিঠে আপনাকে স্বর্গের অনুভূতি দেবে। তবে এখানে ভাপা পিঠের আশা করা বোকামি তাই চা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকাই শ্রেয়।
ভাইজানের শইলডা কি খারাপ?
- না। কেনো বলো তো?
- আপনারে দেইখা মনে অইল। মুখখানা কেমন মলিন হইয়া আছে!
- না আমি ঠিক আছি।
মনে মনে বলতে লাগলাম। ব্যাটা তুই কি মনোবিজ্ঞানী বা সাইকাট্রিস্ট হয়েছিস নাকি? তুই হচ্ছিস চা বিক্রেতা, তুই মুখ দেখে বুঝে ফেললি আমি কেমন আছি?
- ভাইজান কিছু বললেন?
- নাহ! তোমার ছেলেটা কোথায় দেখছি না যে?
- অয় ইস্কুলে গেছে। আপনার কথা মত ভর্তি করাইয়া দিছি।
- বেশ ভালো করেছো। তা কোন স্কুল?
- অইযে রেল লাইনের ওইপারে একটা ইস্কুল আছে অইখানে
- ভালো ভালো। পড়াশুনার খুব দরকার আছে বুঝলে? চায়ের দোকানীর ছেলে যে বড় হয়ে চায়ের দোকানীই হবে এমনতো কোন কথা নাই।
মজনু তার হলদে দাতগুলো বের করে কিছু না বুঝেই বলল - হ ঠিকই কইছেন ভাইজান।
মজনু মিয়ার ছেলের নাম মনু মিয়া। টেইলাররা নিজের সাথে মিলিয়ে তার সন্তানদের উদ্ভট নাম রাখে, তাদের ধারনা তাদের সন্তানও তাদের মত দর্জিই হবে। কোথাও একটা পড়েছিলাম। কিন্তু মজনু এই নাম কেন রাখলো সেইটা মাথায় আসছে না। কখনো জিজ্ঞাসাও করিনি, থাক কিছু ছোটখাটো রহস্য, ক্ষতি কি। পরিবেশ রহস্য ভালোবাসে, রহস্য ভেদ নয়। আমাদেরও তাদের সাথে তাল মিলিয়ে চলা উচিৎ।
এই মনুর কল্যানেই এই দোকানটা চেনা। প্রায় এক বা দেড় বছর আগের কোন এক শীতে হলুদ পাঞ্জাবির কালো চাদর পেচিয়ে খালি পায়ে ট্রেনলাইন ধরে হাটছি। একটা হিমু হিমু ফিলিংস, নাহ হিমু হলে নিশ্চয়ই গায়ে চাদার প্যাচাতো না। সে যাইহোক হিমু হওয়ার ইচ্ছে আমার নেই, ব্যাটা একটা বদ্ধ উন্মাদ।
হেটে হেটে ক্লান্ত হয়ে একটু বসেছি। আমার দৃষ্টি ট্রেনলাইনের উপারের বস্তির এক মহিলার প্রাণপণ চেষ্টার ওপর। তিনি একটা মাটির বানানো চুলা সামনে নিয়ে তাতে খড়কুটো দিয়ে আগুন জ্বালানোর চেষ্টায় ব্যাস্ত। কিন্তু আগুনটা কোনভাবেই জ্বলছে না, উপর দিয়ে অজরহ কালচে ধোয়া বের হচ্ছে। তিনি চেষ্টা বহাল স্বরূপ চুলোর মুখে ফু দিচ্ছে আবার খড়ির এক মাথা চুলায় আরেক মাথা মুখে দিয়ে অনবরত ফুঁকে যাচ্ছেন, কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। এতক্ষনে হয়ত মহিলাটির চোখ রক্তবর্ন ধারন করে ফেলেছে, চোখে পানিও আসার সম্ভাবনা শতভাগ। কেননা এসব ধোঁয়া বেশ মারাত্মক, একবার চোখে গেলে আর নিস্তার নেই।
এসব ভাবতে ভাবতে আনমনে হাটা শুরু করে দিয়েছি। কিছুদূর যাওয়া মাত্রই পিছন থেকে ডাক অনুভব করলাম
- ভাইজান? ভাইজান?
একটা ছেলে কিছু একটা হাতে নিয়ে আমার দিকে ছুটে আসছে। বয়স কত হবে? ৭ কি ৮! কিন্তু আমাকে কেনো ডাকছে বুঝে উঠতে পারলাম না।
- আমাকে ডাকছিস
- হ আপনারেই।
- কিছু বলবি?
- আপনার পকেট থেইক্যা টাহার ব্যাগ পইরা গেছে। এই লন।
আমি অচিরেই পাঞ্জাবীর পকেটে হাত দিলাম। সত্যিই তা! আমার পকেটে মানিব্যাগ নেই।
- বড় উপকার করলি রে ছোকরা। নাম কি তোর?
- মনু মিয়া।
- বেশ ইন্টারেস্টিং নাম। থাকিস কই?
- অইযে অই খাম্বার পাশে আমার বাপজানের দোহান। অইহানেই থাকি।
- তা বেশ। চল তোর বাপজানের দোকান থেকে চা খেয়ে আসি।
ছেলেটার সততা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। বেশ কিছু টাকা ছিল মানিব্যাগে। ভার্সিটির সেমিস্টার ফি! টাকাটা হারিয়ে ফেললে খুব বিপাকে পড়ে যেতাম। জগন্নাথ ইউনিভারসিটি তে অনার্স করছি। টিউশনি করেই আমার পড়াশুনো, থাকা খাওয়ার খরচ চালাতে হয়। এত অল্প টকায় চলাটা রীতিমত যুদ্ধ সামিল। কতদিন না খেয়ে থেকেছি তার কোন হিসেব নেই।
বাবা মারা গেছে বহুত আগেই। মা গ্রামে থাকেন, কিছু হাস,মুরগির ডিম বিক্রি করে কোন মতে নিজে টিকে আছেন। কোথায় আমি তাকে টাকা পাঠাবো তানা সেই উল্টো কষ্ট করে না খেয়ে- না খেয়ে আমাকে টাকা পাঠান মাঝেমধ্যেই। নিজেকে তখন খুব অপরাধী বলে মনে হয়। মায়ের মন, এরা নিজেরা যত কষ্টেই থাকুক না কেন সন্তানদের কষ্টে থাকতে দেবে না। তবে আমার মা একটু বেশিই মমতাময়ী।
মৃন্ময়ী! নামটা যতটা না সুন্দর, নামের মালকিন তার থেকেও বেশি সুন্দর। তার চোখের মায়ার কাছে পৃথিবীর সকল মায়া নস্যি। তার মুখে আকাশ কুসুম রঙের আভা একে দিয়েছেন বিধাতা। শঙ্খগড়ন দেহে মাধুর্যের শীতল সুর বয়ে চলেছে অবিরাম। মেয়েটি কখনো নীল শাড়ী পরেনি। পরলে হয়ত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরীর মুকুট তার মাথাতেই বিরাজ করত।
আমাদের ক্লাসের সব অহংকারী মেয়েদের তালিকা করলে মৃন্ময়ী নামটা শীর্ষচূড়ায় থাকবে। ব্যাপারটা একদিকে ভালো। সুন্দরীদের অহংকার থাকা আবশ্যক। কেননা অহংকার ছাড়া সুন্দরী, লবন ছাড়া তরকারির মত। তাই চরিত্রের সাথে অহংকার ব্যাপারটা শতভাগ মানিয়ে গেছে এতে কোন সন্দেহ নেই।
কিন্তু কিছুদিন পরেই উদ্ভাবন করলাম আমার স্পর্ধা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। গরিবের প্রেমে পরা নিষেধ জনেও আমি প্রেমের কারাজালে বন্ধী হয়ে যাচ্ছি। এবং ক্রমেই এর জাল আমাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরছে। মাকড়শার জালে শিকার আটকালে যেমন তাদের ছোটার কোন পথ নেই, আমার অবস্থাটাও ঠিক একই রকম।
সাহসের চূড়ায় গিয়ে, স্পর্ধার বাধ ভেঙ্গে মেয়েটাকে গিয়ে বলেই দিয়েছিলাম মনের কথা। তবে ফার্মগেটের সস্তা শার্ট, রঙ জ্বলা ময়লা প্যান্ট, ১ বছর পুড়নো জোড়াতালি দেয়া স্যান্ডেল পরা একটা ছেলে এলিয়নের A15 গাড়িতে চড়া একটি মেয়েকে প্রেমের প্রস্তাব দিলে যেমনটা হওয়া উচিৎ আমার সাথেও ঠিক তেমনটাই হয়েছে। তিরস্কারের তীর্যক তীর হৃদপিন্ডটাকে বরাবর আঘাত করলেও, মনে মনে প্রস্তুত ছিলাম। তাই ভেঙ্গে পরিনি। দূর থেকে তো ভালোবাসা যাবে, ক্ষতি কি? আকাশের পিঠে যখন মেঘ চড়ে বসবে তখন না হয় ভালোবাসাগুলো তাদের মাধ্যমেই বিলিয়ে দেবো, তারা বৃষ্টি হয়ে মৃন্ময়ীর জানালায় বর্ষিত হবে। সে কি আঙ্গুল দিয়ে বৃষ্টিকে স্পর্শ করবে না? করবে হয়ত কেননা মেয়েদের বৃষ্টি বড্ড পছন্দ।
মজনু আরেক কাপ চা নিয়ে আসল। শরীরটা আজকে বেশ হালকা লাগছে। শরীরে একটা অঙ্গ কমে গেছে বলে? কতইবা ওজন হবে ২৫০-৫০০ গ্রাম? এর বেশি হবে না হয়ত। তাতেই এত হালকা লাগার কথা না। কারনটা বোধযহয় অন্য।
দিন বিশেক আগে খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দেখে চোক আটকে যায়। আটকাবার যথেষ্ট কারন আছে। " আর্জেন্ট কিডনি চাই। আগ্রহীরা ৩২/এ ধানমন্ডি এই ঠিকানায় যোগাযোগ করুন। মোবাইল নং : ০১৭৩৪২৭৯৮৫১" নিচে একটি মেয়ের ছবি দেয়া হয়েছে, ছবির নিচে ছোট্ট করে লেখা "রোগীর ছবি"
বিজ্ঞাপনে দেওয়া ফোন নম্বরে কল দিয়ে, তাদের কথা অনুসারে ঠিকানা মোতাবেক বাসায় চলে গেলাম।
বাসার কলিং বেল একবার চাপতেই বুয়া টাইপ একজন মহিলা দরজা খুলে দিলেন। রুমে প্রবেশ করতেই সোফায় এক ভদ্রলোককে আবিষ্কার করলাম, বোধহয় আমার জন্যই অপেক্ষা করছেন। তাকে দেখে নিঃসন্দেহে যে কেউই বলে দিতে পারবে তিনি রোগির বাবা। কেননা তার মুখে রাজ্যের চিন্তার ছাপ, বাবা না হয়ে অন্য কেউ হলে এত চিন্তামগ্ন হওয়ার কথা নয়।
তুমিই শুভ্র?
- জ্বী
- বস। তুমি সত্যিই কিডনি বিক্রি করতে চাও?
- জ্বী স্যার। আমার খুব টাকার প্রয়োজন।
- তুমি আমার কত বড় উপকার করলে সেইটা তুমি জানো না। আমি চির কৃতজ্ঞ থাকবো। মেয়েটার শরীর বড্ড ভালো ছিল যান তো কিন্তু হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লো। ডক্টর বললেন একটা কিডনি সম্পূর্ণ বিকল হয়ে গেছে অপরটির অবস্থাও বেশ খারাপ, বিকল হতে চলল বলে। তাই আর্জেন্ট কিডনি প্রয়োজন। আপাতত ডায়ালাইসিস পদ্ধতিতে রক্ত পরিশোধন করা হচ্ছে। এখন আল্লাহ আল্লাহ করে তোমার কিডনি ম্যাচ করলেই হল। ওহ হ্যা! তুমি টাকার কথা বলছিলে। কত টাকা লাগবে তোমার?
- স্যার ২ লাখ।
- সমস্যা নেই টাকার ব্যাবস্থা হয়ে যাবে। তুমি শুধু কালকে সকালে পপুলার হসপিটালে চলে এসো। ডক্টর কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করবেন।
- জ্বী আচ্ছা। আজ তাহলে উঠি।
ভাগ্যক্রমে সকল পরীক্ষার ফলাফলই পজেটিভ। সফল ভাবে কিডনি ট্রান্সফার হয়ে যায়। এরপরে ১০ দিন আমাকে হাসপালে ভর্তি হয়ে থাকতে হয়েছিল। আজই ছাড়া পেলাম, ছাড়া পেলাম বললে ভুল হবে এটাকে পালিয়ে আসাই বলা যেতে পারে।গুমোট ঔষধি গন্ধে দম বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছিল। এখন খোলা শুদ্ধ পরিবেশে নিজেকে স্বাধীন মনে হচ্ছে।
আজও মজনু মিয়ার দোকানে বাকিই খেতে হবে। হাতে টাকা পয়সা নেই, কারন ২ লাখ টাকা না নিয়েই চলে এসেছি। যাকে ভালোবাসি তাকে উপহার দিয়ে টাকা নেবো এতবড় অমানুষ আমি নই।

0 Comments