১০২ ডিগ্রি জ্বর! থার্মোমিটার দিয়ে মাপা হয়নি বটে তবে অনুমান করতে পারছি বেশ। কারন জ্বর-ঠান্ডার সাথে আমার আত্মিক সম্পর্ক তৈরী হয়েছে সেই বহু বছর আগে থেকেই। একটু ছুতা পেলেই জ্বর বাবু মশাই আমার করিডোরে এসে কড়া নাড়ে। তবে এবার তার আগমনের কারনটা ঠিক মিলাতে পারছি না।
সম্প্রতি তাকে উস্কে দেয়ার মত কোন ঘটনা আমি ঘটিয়েছি বলে মনে পরছে না। শহর হয়ত ভাইরাসের কবলে পরেছে, যদি তাই হয় তাহলে এসময় শতকরা ৭০% মানুষ আক্রান্ত হয়ে থাকে, আর আমি তো তার রোজকার কাস্টমার আমাকে ডিসকাউন্টে দিবে না, তা কি করে হয়?
দুইদিন যাবত এই অবস্থায়! গত ৪৮ ঘন্টাই আমি বিছানায় লেপ্টে আছি। জ্বরের এই একটি ভালো দিক আছে বলে আমি মনে করি, ঘুম বঞ্চিত মানুষগুলোকে বিছানা বন্ধী করে ফেলে। তবে আমার ব্যাপারটা আলাদা বিছানায় থাকলেও আমি চোখ বন্ধ করতে পারি না। চোখ বন্ধ করাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে আমার জীবনে।
দুইদিনে সব হিসাব উল্টেপাল্টে গেছে তবে আমার অনুমান শক্তি বলছে আজ ১৩ তারিখ। আর ১৩ তারিখ সন্ধ্যা ৭ টায় গুরুত্বপূর্ণ কাজ রয়েছে। তাই সঠিক সময়টা জানা দরকার। ঘর অন্ধকার বলে দেয়াল ঘড়িটা ঠিক ঠাওয়ার করতে পারছি না। ফোনেও চার্জও দেয়া হয়নি, সুইচ অফ হয়ে গেছে অটোমেটিক্যালি। উঠে লাইট অন করা ছাড়া আর কোনো উপায় দেখছি না, কিন্তু শরীর সায় দিচ্ছে না একেবারেই। ছোট একটা ভাই বা বোন থাকলে দিব্বি হতো, অর্ডার করে করে সব কাজ করিয়ে নেয়া যেত। এইযে এখন লাইট টাও জ্বালিয়ে নিতে পারতাম।
ঘড়ির কাটা ৪:৩০ এর উপর চড়ে বসেছে। মানে হাতে আছে ২ ঘন্টা ৩০ মিনিট। সময়ের পরিসর বেশি মনে হলেও বৃহস্পতিবারের কাছে এটা তুচ্ছ। কারন এই দিনে ঢাকা শহরে সবথেকে বেশি জ্যাম লেগে থাকে, দীর্ঘ ৮ বছরের অভিজ্ঞতা এইটাই বলে। তাই জ্বর নিয়েই বেড়িয়ে পড়লাম গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। যদিও জ্বর কিছুক্ষণ বাদে থাকবে না। কারন আমার জ্বরের পরিধি আড়াইদিন, যেহেতু দুইদিন পেরিয়ে গেছে সেহেতু আশা করা যাচ্ছে সন্ধ্যার আগেই সেড়ে উঠবো।
আমার সামনে সাদা গেট বিশিষ্ট একটা বিস্তর ডুপ্লেক্স বাড়ি। গেটের পাশে নেইমপ্লেটে বড় বড় অক্ষরে লেখা
নবনীড়
হাউজ নং : ৩২/১০/ সি
রোড #০২, শেগুনবাগিচা, শাহবাগ
মানিব্যাগ থেকে ড: আশরাফ চৌধুরী এর কার্ড বের করে সেখানে দেয়া দ্বিতীয় ঠিকানার সাথে মিলিয়ে নিলাম। ভদ্রলোক বাংলাদেশের নামিদামি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। তিনি তার প্রতিটি কেইস সম্পর্ক এ খুব সোচ্চার এবং সফল ও! এসব আমার কথা নয়- বন্ধুর কপচানো বুলি। বৃহস্পতিবার নাকি তিনি তার বাসায় বিশেষ পেশেন্ট দেখেন, বন্ধুর রিকম্বিনেশনের জন্য আমাকে সেই সুযোগ দিয়েছেন।
সাতপাঁচ না ভেবে গেটের বাইরে থাকা কলিং বেলে প্রেস করলাম। দুইবার প্রেস করতে ভুঁড়িওয়ালা বেটে একজন দারোয়ান বেরিয়ে এলো। ব্যাটার চেহারা এমন যে এই চেহারা দেখলে আপনার ভালো মুডটা বিগড়ে যাবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
- জে বলেন, কি দরকার?
- আমি আসলে ডাঃ আশরাফ চৌধুরীর কাছে এসেছি, আমার এপয়েন্টমেন্ট নেয়া আছে আজকের।
- আপনে দাঁড়ান, আমি স্যার রে জিগাই আহি।
টেলিফোনে ঘেটে, ১ মিনিটের মধ্যে ফিরে এলো।
- যান! স্যার যাইতে বলছে। সোজাই পথ তয় রুম কলম ডাইন পাশে।
- ধন্যবাদ
কথা বুঝতে সামান্য কষ্ট হলেও, দারোয়ানের ডিরেকশন অনুযায়ী অগ্রসর হলাম। বুকশেলফে বই খুঁজতে থাকা খয়েরী পাঞ্জাবি পরিহিত মধ্যবয়স্ক একজনকে আবিষ্কার করলাম। বয়স কত হবে এই ৪০ কি ৪৫! ভরাট চোয়ালের বেটে-খাটো লোক। সদ্য দাড়ি কামিয়েছে বলে মনে হচ্ছে, দাড়ি থাকলে মনে হয় খারাপ লাগতো না বরং মানাতো বেশ।
তবে আমার ধারনা ছিলো সাইকিয়াট্রিস্টরা টিভি-সিনিমায় দেখানো সাইকিয়াট্রিস্টদের মতই হাস্যউজ্জ্বল, মজার এবং সামান্য পাগলাটে ধরনের হয়। কিন্তু তাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি গম্ভীর টাইপ এবং বেশ পরিপাটি।
- জাকারিয়া সাহেব বসুন।
- ধন্যবাদ।
- আপনার সমস্যার কথা কিছুটা আপনার বন্ধুর মুখে শুনেছি। বিষয়টা ইন্টারেস্টিং এবং ক্রিটিক্যাল মনে হয়েছে বলেই আপনাকে আজ আসতে বলেছি। এবার বিস্তারিত আপনার মুখ থেকে শুনতে চাই। খুলে বলুন।
- আমার সমস্যাটা মূলত চোখ বন্ধ করলেই শুরু হয়। এবং ঘুমালে এর ভয়াবহতা আরো বাড়ে।
- যেমন? খোলাসা করে বলুন।
- আমি ঘুমালে ভয়ংকর কিছু স্বপ্ন দেখি। এবং প্রত্যেকটি স্বপ্নে একটি ছোট্ট বাচ্চা আসে। তার দেহ রক্তাক্ত, শরীরের হাড়গোড় ভাঙ্গা, তার বিদঘুটে চোখে ক্রোধের প্রতিফলন। প্রতিবার আমাকে মারার জন্য তেরে আসে। আমার শরীর ক্ষতবিক্ষত করে ফেলে, শরীরের মাংস খাবলে নেয়, রক্ত চুষে নেয়, পায়ের নখ তুলে ফেলে- ইত্যাদি ভয়ংকর সব কর্মকান্ড ঘটায়। এবং স্বপ্ন ভাঙ্গলে উঠে দেখতে পাই সত্যি সত্যি আমার সারা শরীরে ক্ষতর চিহ্ন এবং সেখানে প্রচুর যন্ত্রনা হয়।
- স্ট্রেঞ্জ!!!
- হ্যা আর চোখ বন্ধ করলে কানের কাছে "কাঠগোলাপ" "কাঠগোলাপ" ধ্বনি শুনতে পাই, যা আস্তে আস্তে বিকট শব্দ ধারন করে। তখন মনে হয় আমার মস্তিষ্ক যেন ফেটে যাচ্ছে।
- আপনার সমস্যার একটা ব্যাখ্যা আমি মনে মনে দাড় করিয়ে ফেলেছি। আমার ক্যালকুলেশন বলছে এইটা পূর্ব ঘটিত কোন কারনের জন্য ঘটছে। তার আগে বলুন তো সমস্যাটা কবে নাগাত শুরু হয়েছে।
- আপনার ধারনা হয়ত সঠিক। কেননা সমস্যাটার সূত্রপাত হয় পূর্বের একটি ইন্সিডেন্টের পর থেকেই। বছর চারেক আগের কথা। একটি পাবলিক ইউনিভার্সিটির ২য় বর্ষের ছাত্র তখন। রুপার সাথে প্রথম দেখা ইউনিভার্সিটিতেই হয়েছিলো। নীল রঙের একটা শাড়ী পড়া মেয়েকে আবিষ্কার করলাম বট বৃক্ষের নিচে দাঁড়ানো, হকচকিয়ে গিয়েছিলাম একেবারে! গায়ের রঙের সাথে নীলটা বেশ মানিয়েছে, মানিয়েছে বললে ভুল হবে অসম্ভব মানিয়েছে। অসম্ভব সুন্দর তার চোখ গুলো, টানা টানা মায়াবী চোখ সেই মায়ার কাছে যেন সারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড নুয়িয়ে রয়েছে। তার চারিপাশে জোৎস্মাগুলো আপন উদ্যমে তাকে জোৎস্মা স্নানে মগ্ন করে রেখেছে যেমন পূর্নিমার সময় চাঁদকে করে। এ রমনী যেন চাঁদকেও হার মানিয়েছে তার সৌন্দর্য্য দিয়ে।
আমার তো মনে হয়েছিলো এই রুপাকে দেখেই হুমায়ূন আহমেদ রুপার চরিত্র কল্পনা করেছিল। আমি বাজি রেখে বলতে পারি রবীন্দ্রনাথ একে দেখলে লাবন্যলতাকে হাটিয়ে একেই তার চরিত্র বানিয়ে ফেলতেন। কাপুরুষতার তকমা কপালে লেপে বেচে থাকতে চাইনি বলেই বছরখানেক পরে ভালোবাসার পর্দা উত্থান ও করেছিলাম।
- তারপর??
- রাজীও হয়েছিলো। সুখের স্বর্ণাক্ষরে দিনগুলো লিখছিলাম দুজন। ছেলে-মেয়ের নামও ঠিক করে ফেলেছিলাম। সে এক উদ্ভট নাম! ছেলে-মেয়ে যাইহোক নাম হবে "কাঠগোলাপ" এইটাই রুপার আবদার। যদিও আমি এর বিপক্ষে ছিলাম, এইটা কোন নাম হলো বলুন? যাইহোক পর্যায়ক্রমে শারীরিক সম্পর্ক ও গড়ে উঠেছলো। আর দুর্ঘটনাটা এখানেই ঘটে। এক্সিডেন্টলি রুপা কনসিভ করে বসে। তখন আমি ৪র্থ বর্ষের ছাত্র। পড়াশুনো, ক্যারিয়ার, ভবিষ্যৎ নিয়ে একতরফা ভেবে বিয়ের জন্য দ্বিমত পোষণ করি এবং এবরশন করাতে বাধ্য করাই। এরপর সেই শোকে রুপা আস্তে আস্তে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পরে। এবং পালাক্রমে আমার এই সমস্যা দেখা দেয়
- জাকারিয়া সাহেব আপনি ঠিক ধরেছেন, এই কারনেই আপনি এই সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন বলে আমারও ধারনা। তবে আপনার বর্বরতা আমার কষা সব সমীকরণ গুলো পাল্টে দিচ্ছে, এবং যে সমীকরণের সমাধানও আমি করতে চাই না। কেননা প্রকৃতি রহস্য বড্ড ভালোবাসে, এবং কিছু রহস্যের উদঘাটন না করাই শ্রেয়। আপনার নামটা নাহয় আমি আনসলভড ডায়েরিতেই লিপিবদ্ধ করে রাখবো। আপনি এবার আসুন।
- ধন্যবাদ
আমি আর কথা না বাড়িয়ে বেরিয়ে এলাম কেননা লোকটার মনুষ্যত্ব আমাকে মোহিত করেছে। এসব ভালোমানুষের জন্যই পৃথিবীটা টিকে আছে আজও।
আজ হয়ত পূর্নিমা, ভরাট জোৎস্নার হাট বসেছে আকাশ জুড়ে তবুও সোডিয়ামের নিয়ন আলোর হলদেটে আভা দমিয়ে রাখছে সারা শহরকে। জ্বলন্ত সিগারেটের নিকোটিনের ধোঁয়ার সাথে সহস্র দীর্ঘশ্বাস দিয়ে ভারি করে তুলছে নগরীকে ঠিক যেন আমার মত করেই। তবে আমার এসব ভাবলে চলবে না, আমার যে ঘুমোতে হবে!
বাংলা রহস্যময় গল্প, সাইকো থ্রিল

0 Comments